Dimla's Landlord

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ উবাভ নিউজ

দিল্লীর মোঘল সম্রাট অরঙ্গজেবের সময় বাংলার সুবেদার ছিলেন তার মামা শায়েস্তা খাঁ। শায়েস্তা খাঁর পুত্র এবাদত খাঁ ঘোরাঘাটের ফৌজদার ১৬৮৭ সালে কোচবিহারে মহারাজা মহিন্দ্র নারায়নের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষনা করে কোচরাজ্যের ৬টি চাকলার মধ্যে কাজীরহাট(নীলফামারী) সহ কাকিনা(লালমনিরহাট) ও ফতেহপুর(কুড়িগ্রাম-গাইবান্ধা) দখল করে নেয়।পরবর্তীতে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বৃহত্তর কাজীরহাট ভেঙ্গে তুষভান্ডার,টেপা,বোদা ও ডিমলার জমিদারিতে বিভক্তিকরণ হয়।

ডিমলার জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাবু হররাম সেন। অবশ্য তাদের বংশ পুরুষ জগতভল্লব সেন উড়িষ্যা নবাবের দপ্তরে উচ্চপদস্থ প্রাশাসনিক  কাজে নিযুক্ত ছিলেন,হররাম সেন  উড়িষ্যা থেকে বংলায় প্রথম এসে রংপুরের মাহিগঞ্জ কুঠি স্থাপন করেছিল।১৭৫৫ সালে বাংলার সুবেদার আলিবর্দ্দীর আমলে বাবু হররামকে অত্র অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের কাজে নিযুক্ত করেন। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজ কোম্পানি বাবু হররামের কার্যদক্ষতা ও শাসনকৌশলে মুগ্ধহয়ে ডিমলার জমিদারীত্ব প্রদান করে।

তার সময়   রংপুরে কৃষক ও প্রজাবিদ্রোহের (১৭৮০-১৭৮৩খ্রিঃ) দেবীসিংহের সহকারী হিসেবে হররাম সেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পক্ষ অবলম্বন করলে কাজীরহাট পরগণারসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।তখন ডিমলায় তাঁর কাচারী বাড়ীতে বিদ্রোহী প্রজারা অগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। কৃষক বিদ্রোহের সময়  বিদ্রোহীগন কে বাধা দিতে গিয়ে প্রাণ হারায় ডিমলার অন্যতম জমিদার গৌর-মোহন চৌধুরি।

উল্লেখ্য, বাবু হররাম সেনের নামের পূর্বে “বাবু” শব্দটি বাংলার নবাবদের থেকে তার উপাধি ছিল। বাবু হররামের নামানুসারে বাবুরহাট নামকরন হয়েছে। হররামের মৃত্য হলে তদীয় পুত্র রামজীবন ডিমলার জমিদারীত্ব পায়,তিনি রামমন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন এখনো তার নামে একটি রামডাঙ্গা গ্রাম রয়েছে, তিনি ১৮০৭ মারা যান।পরবর্তীতে তার পুত্র জয়রাম জমিদারিত্ব পান, তিনি অনেক দানশীল বলে খ্যাত ছিলেন,জয়রামের মৃত্যু হলে তার দত্তক পুত্র নীলকমল ডিমলার জমিদারীত্ব লাভ করেন, তিনি অল্প  বয়সে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান,নীল কমলের কোন সন্তানাদি না থাকায় মৃত্যুর আগে তিনি স্ত্রী শ্যামাসুন্দরীকে চৌধুরানি দত্তক গ্রহন করতে বলেছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে  শ্যামাসুন্দরী , জানকীবল্লভ সেনকে বর্ধমান জেলার বাগনা গ্রাম থেকে  দত্তক গ্রহন করেছিলেন।

আতঃপর জানকীবলস্নভ সেন ডিমলার জমিদারিত্ব পেয়ে নিজে যোগ্য শাসক হিসেবে গড়ে তোলেন।তিনি   তৎকালীন অবৈতনিক ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন, এছাড়াও  লোকাল বোর্ড চেয়ারম্যান, রংপুর জেলা বোর্ড সদস্য, রংপুর পৌরসভার চেয়ারম্যানের আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন। রংপুর শহরে তার বাগানবাড়ি ছিল।সেই বাগান বাড়ীটি  পৌরসভার কার্যালয় হিসাবে তিনি ব্যবহার করতেন সর্বশেষ তিনি পৌরসভার ভবনটি দান করে দেন।

তিনি পৌর চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময় রংপুর শহরে “শ্যামা সুন্দরী ক্যানেল” খনন করেন। সেই সময় মশার উপদ্রব ও ম্যালেরিয়া রোগের প্রকব অনেক বেশি ছিল।উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিলনা তাই ম্যালেরিয়া প্রভাবে বছর বছর অসংখ্য রোগি মারা যেত।রক্ষাপায়নি জমিদারের মাতা শ্যামা সুন্দরী। তিনিও ম্যালেরিয়া রোগে মারা যান। মাতৃ বিয়োগের পর জানকীবল্লভ  সেন মনে কষ্ট নিয়ে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ প্রকল্পে রংপুর শহরের মধ্যে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের জন্য একটি ক্যানেল খননের পরিকল্পনা করেন।তারই  ফলশ্রুতিতে পশ্চিমে ঘাঘট নদী থেকে শহর হয়ে পূর্বে মাহিগঞ্জ পর্যন্ত ১৪কি:মি: দৈর্ঘ্য এবং ১২০ ফুট প্রস্থ ক্যানেলটি খনন করেন (১৮৯০খ্রিঃ)। তিনি জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও জলাবদ্ধতা অবসান উন্নয়নকাজে সক্ষম হলে,রংপুর জজকোর্ট ভবনের পাশে ক্যানেলটির উত্তর পারে তার মাতা শ্যামাসুন্দরীর নামে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন।

“মাতা শ্যামাসুন্দরীর স্মরণের তরে,
জানকীবল্লভ সূত এই কর্ম করে।”

এছাড়াও তিনি সমগ্র বঙ্গদেশের বহুজমিদারদের বিপদে সহযোগিতা করেছেন,তৎকালীন প্রজাদের  আভাবের ৭৫ হাজার টাকার খাদ্য,রংপুর অঞ্চলে কৃষি গবেষণায় ৮ হাজার টাকা দান করেছিল। শুধু রংপুর সীমানায় নয় তার তিনি দার্জিলিং শৈল শিখরে হিন্দুদের জন্য হাসপাতাল নির্মান করে প্রজাদরদী মনের পরিচয় বহন করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তার কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে  ১৮৯১ সালে তাকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন।

জানকীবল্লভ সেন মৃত্যপূর্ব তথা ১৯০৮ খ্রিঃ এক উইল বলে ডিমলা জমিদারীকে  মুজকুরী ও দেবোত্তর এস্টেটে বিভক্ত করেন । দেবোত্তর এস্টেটের শুধু জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ১২৬৫ একরসহ বহু অস্থাবর সম্পত্তি। একমাত্র নাটোরের মহারানী রানী ভবানী ছাড়া এতবড় দেবোত্তর এস্টেট সাবেক রঙ্গপুর জেলায় এমনকি উত্তরবঙ্গের আর কোন জমিদারীতে ছিল না। এই দেবোত্তর এস্টেটের প্রথম সেবায়েত নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ছিলেন তার  স্ত্রী শ্রীমতি রানী বৃন্দারানী।

জমিদার জানকীবল্লভের মৃত্যুকালে ডিমলা জমিদারীর মোট আয় ছিল ২ দশমিক ৩৮ লক্ষ টাকা ও সরকারী জমা ছিল ৩৫ হাজার টাকার উপরে।

জমিদার জানকীবল্লভ সেন স্ত্রী ও কিশোর পুত্র যামিনী মোহন কে রেখে ১৯১০খ্রিঃ ১৪ অক্টবর মানবলীলা ত্যাগ  করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল আনুমানিক ৭৫ বছর।

শ্রীমতি রানী বৃন্দারানী চৌধুরানী অনেক দানশীল জমিদারনী ছিলেন, রংপুরের কারমাইকেল কলেজে প্রতিষ্ঠাকালীন তার আবদান উল্লেখ যোগ্য।তিনি কলেজের দাতা সদস্য ছিলেন।*(৮) এছাড়াও তিনি ১৩০৪ বঙ্গাব্দে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পাহাড়ের চূড়ায় চদ্রনাথ ও বিরুপাক্ষ মন্দিরের উঠার সিঁড়িঁ ও লৌহ সেতু নির্মান করে দেন এবং তাহার স্বামী রাজা শ্রী জানকীবল্লব সেনের নামে স্মৃতি ফলক বসান।গবেষকদের মতে,”সতীর স্মৃতি বিড়জিত চট্রগ্রামের চন্দ্রনাথ ধামের নাম প্রথমে ছিল সতীকুন্ড কালের বিবর্তনে তা সীতাকুন্ড হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।”

প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী(শিব চতুর্দশী) তিথিতে মানুষের মেলা বসে চট্রগ্রাম শহর থেকে ৩৭ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত সীতা কুন্ড পাহাড়ে। ৩৫০ কিলোমিটারের এক বিশাল অংশের পাহাড় এলাকা ঘিরেই আবর্তিত এ তীর্থক্ষেত্র।এটি হিন্দুদের তীর্থস্থান। তাই তো কবি বলেছেন-

‘‘তীর্থের মহিমা না করা যায় বর্নন, করিলে ভ্রমন হয় মনের পবিত্রতায় পূন্য সঞ্চালন’’

১৩২৫ বঙ্গাব্দে মন্দির গুলো ক্ষতিগ্রস্থ হলে শ্রীমতী বৃন্দারানী চৌধুরানী বহু অর্থ ব্যায় করে মন্দির গুলোর পূর্নসংস্কার করে দেন।*(৯) এছাড়াও নিজ বাড়ীর  ডিমলার অদুরে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন যা রানী বৃন্দা রানী  উচ্চ বিদ্যালয় সংক্ষেপে আর.বি.আর উচ্চ বিদ্যালয়। এই বংশের শেষ জমিদার যামিনী মোহন।

ডিমলায় বিশাল জমিদারীত্বের জন্য ডিমলা রাজবাড়ী নামেই খ্যাত ছিল,বর্তমান মূলবাড়ীটির চিহ্নমাত্র নেই যা কালের স্রোতে নিশ্চিত হয়ে গেছে, ঐ স্থানটিতেই নিরবে দারিয়ে আছে পুরাতন বটবৃক্ষ।

তথ্যসূত্রঃ

(১)কোচবিহারে ইতিহাস, পৃঃ২১৯.
(২)বাংলাপিডিয়া।
(৩)কোচবিহারে ইতিহাস, পৃঃ২২৯.
(৪) বৃহত্তর রংপুরের ইতিহাস,পৃঃ৩৩.
(৫)রঙ্গপুর প্রত্নসম্পদ,পৃঃ৩৯.
(৬)বংশ-পরিচয়,২য় খন্ড,পৃঃ৯২.
(৭) ইন্টারনেট।
(৮) কারমাইকেল কলেজর ভিত্তি ফলক থেকে গৃহীত।
(৯)মুক্তাগাছা নিউজ, প্রকাশকাল;১১/০৪/২০১৪ইং।

লেখকঃ মোঃআলমগীর হোসেন (সংবাদকর্মী)

Leave a Reply

Your email address will not be published.

2 × two =