বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তা,ধরলা সহ বেশকয়েটি নদ-নদীতে পানি সংকটে ঐতিহ্যবাহী বৈরালি মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। হিমালয়ের ৭২০০ মিটার উচ্চতায় সিকিম অংশে, চিতামু হ্রদ থেকে নেমে আসা তিস্তা-ধরলার স্রোত ধারায় ভরত,নেপালের পাহাড়ী ঢলে এবং দেশের উত্তরের জেলা নীলফামারী,লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামসহ ব্রহ্মপুত্র নদের দীর্ঘ এলাকায় নিয়ে বৈরালির মাছের বিস্তার । স্বচ্ছ ও মিঠা পানির মাছ হওয়ায় তিস্তা নদীতেই এক সময় প্রচুর পরিমাণ বৈরালি মাছের দেখ মিলত।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, ‘গত শতকের ।আশি-নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত তিস্তায় বিভিন্ন জলজ প্রানী যেমনঃ শুশুক , ঘরিয়াল ও মিঠা পানির কচ্ছপ এবং বেশকিছু বড় আকারের মাছঃ বাগাইর,আইর,বোয়াল,কর্তী, বায়ম, গজারের দেখা মিলত।’এখন আর ঐ সমস্থ জলজপ্রানী ও মাছগুলো আগের মত দেখাই যায় না। তিস্তানদীতে ভারতে একাধিক জায়গায় সেচ প্রকল্প (বাঁধ) তৈরি করা হয়েছে।যার ফলে জলাশয় শুকিয়ে অন্যান্য মাছের মত এখন বৈরালির প্রচুর্য হ্রাস পেয়েছে। আঞ্চলিক ভাষায় ডাকা হয় ‘বৈরাল’ বা ‘বৈরালি’ কিংবা ‘বৈরালী’। আর পার্শবর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ‘বোরেলি’ নামে পরিচিত।মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম-বারিলিয়াস বারিলা(Barilius Barila)। এছাড়াও Barilius Barna, Barilius Tileo,Barilius Vagra, Barilius Bendelissis প্রজাতি রয়েছে।গ্রীস্মকালীন সময়ে বৈরালি মাছ বংশবিস্তার করে থাকে। বৈরালি মাছের গঠন লম্বা ও সরু এবং পাশে সামান্য চাপা হয়ে থাকে।উভয় চোয়ালের দৈর্ঘ্য সমান,পেছনের দিকে চোখের নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত।আকারে সর্বোচ্চ ১০ সেন্টিমিটার বা ২-৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ এবং প্রস্থে ১-১.৫ সেন্টিমিটার বা ১ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। ছোট আঁশ বিশিষ্ট সম্পূর্ণ রুপালী রঙের মাছটির পিঠে একটু হালকা মেটে এবং পেটে হলদে দাগ থাকে। বৈরালির ভিতরে সম্পূর্ণ পুটিমাছের ন্যায় কাঁটা থাকে তবে বেশ নরম।স্রোতের বিপরীতে ঝাঁক বেধে চলা দ্রুতগামী এই মাছটি চরিত্রিক বৈশিষ্ট ও স্বাদে অতুলনীয় প্রায় ইলিশের মত হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের মানুষের কাছে বৈরালি- ‘দ্বিতীয় ইলিশ’ খ্যাত। বৈরালি মাছ এতটাই সুস্বাদু যে রংপুর অঞ্চলের বাহিরে থেকে আসা অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।সাধারনত ছোট বৈরালি ভুনা করে রান্না করা হয় এছাড়া আকারে বড় বৈরালি পটল,বেগুন, ঝিঙা,ডাটা ও আলু মিশিয়ে রান্না করলে স্বাদের তুলনা হয় না।কিন্তু বর্তমানে ব্যপক চাহিদা থাকলেও তিস্তা নদীর পার্শবর্তী হাট-বাজার ও ব্যারেজ এলাকায়(ডালিয়া-দোয়ানী) স্বল্প হারে পাওয়া যায় বৈরালি। আগের তুলনায় দামও চড়া। ছোট বৈরালির মূল্য কেজি প্রতি ক্রেতাকে গুনতে হয় (৪৫০-৫৫০)টাকা এবং আকারে বড় পাওয়া দুস্পাপ্য, হটাৎ মিললে (৫৫০-১,০০০)টাকা পর্যন্ত তাই জনমনে হতাশা বিরাজ করছে। একটা সময় তিস্তার তীরবর্তী ও চরাঞ্চচলের মানুষেরা শখের বসে দল বেঁধে নদীর জলে মাছ ধরতে নামত।জেলে ও মাঝি-মাল্লারা জীবিকার সন্ধানে রাতদিন কর্মব্যস্তায় পড়ে থাকত নদীতে।
বাংলাদেশ সীমান্তের ৫০ মাইল উজানে ভারতে গজলডোবা এলাকায় তিস্তায় ২১১.৫৩ মিটার লম্বা বাঁধ করা হয়েছে।এতে দুটি সেচ ক্যানেলের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে প্রায় ৯ লক্ষ হেক্টর কৃষি জমিতে সেচ প্রদান করা হয়।গজলডোবা সেচ প্রকল্প বাদেও নদীর উজানে রয়েছে অসংখ্য ড্যাম,জলবিদ্যুৎ প্লান্ট ।এসকল বাঁধ নির্মাণ ফলে,পানি প্রবাহ অনেকটাই ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ঐতিহাসিক ভাবে একসময় তিস্তার পানিপ্রবাহ ছিল গড়ে সর্বোচ্চ ২ লক্ষ ৮০ হাজার এবং সর্বনিম্ন ১০ হাজার কিউসেক। আর বর্তমানে শুস্ক মৌসুমে গজলডোবা ব্যারেজের গেট চুইয়ে এবং এর ভাটির উপনদীর পানি মিলে হয় মাত্র ৬০০ কিউসেক। দীর্ঘদিন ধরে নানা আন্দোলন করে তিস্তারপানির ন্যায্য হিস্যা দাবি করেও কোন সুফল মেলেনি।দেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী তিস্তার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় অন্যান্য প্রায় ছোট বড় ২০ টি নদ-নদী পানি শূন্যতায় মৃতপথে। বিশেষ করে লালমনিরহাটের নদীগুলোর অস্তিত্ব বিলীন প্রায়। এছাড়া লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা দোয়ানিতে ও নীলফামারীর ডিমলার ডালিয়া সীমান্তে এলাকায় দেশের বৃহত্তম সেচপ্রকল্পের অবস্থান।তিস্তা ব্যারেজ এলাকার উজানে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত ডিমলা এলাকার ৭-৯ কিঃমিঃ নদীতে সামান্য কিউসেক পানি মজুদ থাকলেও জেগে উঠেছে অনেক দ্বীপচর।দীর্ঘদিন জেগে থাকা ঐসমস্থ চরাঞ্চালে জমিগুলোতে শুরু হয়েছে ভূট্টা,আলু,গম,বাদাম ও পিঁয়াজ সহ নানান রকমের মসলা জাতীয় ফসলের চাষাবাদ।চাষযোগ্য কৃষি জমিতে প্রচুর রাসায়নিক সার,কীটনাশক প্রয়োগের ফলে এগুলো নানা মাধ্যমে নদীর পানিতে গড়িয়ে মাছের ডিম ও সদ্যজাত পোনা বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে।আর এইসময় সেচ মৌসুম হওয়ায় ব্যারেজ এলাকার ভাটিথেকে -ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত ধূ-ধূ মরুভূমি।জরিপ অনুযায়ী, ‘১৯৮৪-৮৫ সালে যখন কোন বাঁধ ছিল না তিস্তায়সহ পার্শ্ববর্তী নদী গুলো থেকে বছরে ৮০০০ টন মাছ পাওয়া যেত।’বর্তমানে চাহিদা থাকলেও এর সূচক হাজার টনেরও নিচে নেমে গেছে যা অতি সামান্য পরিমান। বর্তমানে পানির অভাবে তেমন কোন মাছ নেই , জেলেদের জাল টানারও জায়গা নেই। অতীতের ন্যায় মাঝি-মাল্লাদের নেই আর দৌড়ঝাঁপ।নদীর পানির শূন্যতায় থমকে গেছে নীলফামারী ডিমলাসহ পার্শবর্তী জেলা লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের বেশকয়েকটি উপজেলা এবং রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার হাজারো পরিবারের উপার্জন । অনেকে জেলে ও মাঝি পেষা ছেড়ে শহরে গিয়ে হয়েছে ছিন্নমূল কেউ বা মানবতার জীবন-যাপন করছেন। তিস্তার পানি সংকটে এবং কীটনাশকের প্রভাবে ধরলা সহ দেশের উত্তরের বেশ কয়েকটি নদ-নদীতে অতীতের ন্যায়, জেলেদের জালে এখন আর ঝাঁক বেঁধে ধরা পড়েনা ঐতিহ্যবাহী মাছটি।পদ্মার ইলিশের মত সুস্বাদু ও জনপ্রিয় বৈরালি মাছটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।