তিস্তা নদীতে এক সময় সারি সারি পাল তোলা নৌকা চোখে পড়লেও কালের বিবর্তনে, জৌলুস হারানো তিস্তার করুণ অবস্থা আর যান্ত্রিক সভ্যতা বিকাশের ফলে বিলুপ্তি এখন সেই পাল তোলা নৌকাগুলো।
অবশ্য প্রতিবছর বিভিন্ন উৎসব কেন্দ্র করে হাতে গোনা দু’একটা পালের নৌকা চোখে পড়ে তিস্তা ব্যারেজ এলাকায়(ডালিয়া-দোয়ানী)। গত দশকের শরুর দিকেও তিস্তা নদীর নৈসর্গিক রূপের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছিল সারি-সারি অসংখ্য রঙ্গিন পালের নৌকা। তিস্তা বেষ্টিত বেশির ভাগ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল নদী আর পালের বড় নৌকা, ডিঙ্গি নৌকাসহ বিভিন্ন নৌকার সম্পর্ক।
রঙিন পালের এসকল নৌকা যখন তিস্তা নদীতে ভাসত, স্বচ্ছ পানির কলতান আর পালে লাগা বাতাসের শনশন শব্দ অনুভূতি জুগিয়ে তুলতো প্রাণে। নৌ-পথকে ঘিরে এক সময় পাল তোলা নৌকা ছিল আমাদের একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম।যাতায়াতে যেটুকু না তৃপ্ত হতো তীরে থেকে সারি সারি নৌকার ছন্দবদ্ধ চলা আর বাতাসে পাল উড়ার মনোরম দৃশ্য দেখে মনপ্রাণ আনন্দে নেচে উঠত।আর মাঝ নদী থেকে ভেসে আসা দরাজকণ্ঠে ভাটিয়ালি গানের সুর শুনে তৃপ্ত এনে দিতো মনে।
আবহমান গ্রামবাংলার লোক সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ছিল এই পাল তোলা নৌকা।প্রখ্যাত শিল্পীরা তৈরি করেছেন উঁচু মানের শিল্পকর্ম। শুধু দেশি কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী বা রসিকজনই নন বরং বিদেশী অনেক পর্যটকের মনেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে পালের নৌকা।বিখ্যাত লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাসে ত্রিস্রোতা নামে যে নদীটি উল্লেখ করেছেন,তাই মূলত এই তিস্তা।এই নদীতে সর্বক্ষন ছুটে চলেছে জয়দূর্গা দেবীর চৌধুরানীর বজরা।ভূটান সহ উত্তর-পশ্চিমের অনেক দেশ হতে নানা পন্য পরিবহনে
বিভিন্ন আকার ও ধরনের পালের নৌকাই ছিল নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।সাম্পন, যাত্রীবাহী গয়না, একমালাই , কোষা, ছিপ, ডিঙি , পেটকাটা,বোঁচা সহ বিভিন্ন ধরনের নৌকার ব্যবহার ছিল। আর এসকল নৌকায় উড়ানো হত, হাজারীপাল, বিড়ালীপাল, বাদুরপাল ইত্যাদি রকমের রঙ্গিন পাল ।
পালের নৌকার পাশাপাশি মাঝিদেরও বেশ কদর ছিল এক সময়। প্রবীণ মাঝি-মাল্লা’রা নৌকা চালানোর বিভিন্ন কলাকৌশল সম্পর্কে বেশ পারদর্শী ছিলেন। তাদের হিসেব রাখতে হতো, শুভ-অশুভ ক্ষণের। কথিত আছে, বিজ্ঞ মাঝিরা বাতাসের গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারতেন ঝড়ের আগাম খবর। রাতের আঁধারে নৌকা চালানোর সময় দিক নির্ণয়ের জন্য মাঝিদের নির্ভর করতে হতো আকাশের তারার ওপর। তাই আগে ভাগেই শিখে নিতে হতো কোন তারার অবস্থান কোন দিকে।তবে কালের পরিক্রমায় পাল তোলা নৌকা এখন শুধুই অতীত। কেননা,তিস্তা নদীতে যেটুকু সময় পানি থাকে বিশেষ করে ভড়া বর্ষায় শুধু নৌকা চলাচল করে।কারন, তিস্তার ভাটিদেশ যে এখন বালুচর।
১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ-ভারত মন্ত্রী পর্যায়ের চুক্তি অনুযায়ী তিস্তার পানির ৩৮ শতাংশ ভারত এবং ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ। আর নদীর নাব্য ঠিক রাখতে ২৬ শতাংশ পানি রিজার্ভ রাখা হবে। কিন্তু সেটি চুক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। উল্টো তিস্তা ব্যারাজের উজানে ভারত গজল ডোবায় বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় তিস্তায় পানি প্রবাহ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। ফলে নাব্য হারিয়ে প্রমত্তা তিস্তা এখন সরু খালে পরিণত হয়েছে। তিস্তা ব্যারাজের ভাটি এলাকা এখন মরা গাঙ্গে পরিণত হয়েছে। তিস্তায় পানি প্রবাহ না থাকায় এর প্রভাব পড়েছে অন্যান্য নদ-নদীতে। যৌবন হারা তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে বড় বড় চর। যতদূর চোখ যায় শুধু ধু-ধু বালুচর। তিস্তার বুক চিরে এখন নৌকার পরিবর্তে চলাচল করছ ট্রক্টর,ঘোড়ারগাড়ি ইত্যাদি পরিবহন।
অার এদিকে,যান্ত্রিক সভ্যতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে পালতোলা নৌকা। কদর নেই মাঝি-মাল্লাদেরও।ছবিতে মাঝি-মাল্লাদের গুন টানার দৃশ্য,নৌকায় পাল এবং দাঁড়-বৈঠার পরিবর্তে স্হান দখল করে নিয়েছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। এসব নৌকার ভট-ভট বিকট শব্দে নদীর শান্ত পরিবেশ বিঘ্নিত হয়,সেই সাথে নৌকার ইঞ্জিনের তৈল ও পোড়া মবিল পানিতে ভেসে তিস্তার পানিও দূষন হচ্ছে।
কালের আবর্তে হয়ত কোন সময় পরবর্তী প্রজন্মের শিশুরা ভুলে যাবে,পালের নৌকা নিয়ে গাওয়া বাইচের গান কিংবা ‘‘পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও’ ইত্যাদি ছড়া।